১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য ও ইতিহাস

১৯৪৭ সালের ১৪/১৫ আগস্ট ইংরেজ মস্তিষ্কপ্রসূত দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে দ্বিখন্ডিত হয় ভারতবর্ষ জন্ম নেয় ভারত  কিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র পাকিস্তানের আবার দুটি অংশ- পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানজন্মলগ্ন থেকেই বাঙালিপ্রধান পূর্ব পাকিস্তানের শোষক, নির্যাতক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে পশ্চিম পাকিস্তান হাজার বছর ধরেই ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলীয় বঙ্গভূমির জনগণের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও

১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ভাষণকালে কায়েদে আজম মোহম্মদ আলি জিন্নাহ ঘোষণা করলেন, “উর্দু, এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাতার ঘোষণায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে গোটা বাংলা

তৎকালীন বহুভাষিক রাষ্ট্র পাকিস্তানে বিভিন্ন অঞ্চলে মাতৃভাষাভিত্তিক পরিসংখ্যানমতে,

1.            বাংলায় কথা বলে প্রায় ৫৪% জন
2.            পাঞ্জাবিতে প্রায় ২৭% জন
3.            উর্দুতে প্রায় % জন
4.            পশতুতে প্রায় % জন
5.            হিন্দিতে প্রায় % জন
6.            ইংরেজিতে প্রায় % জন

গণ-আজাদী লীগ : ভাষার দাবীতে সোচ্চার

১৯৪৭ সালে জুন মাসের শেষ দিকে ঢাকায় গঠিত হয় আদর্শভিত্তিক একটি ক্ষুদ্র সংগঠন : গণ-আজাদী লীগ [East Pakistan Peoples’ Freedom League] প্রতিষ্ঠাতা প্রধান আহ্বায়ক : কমরুদ্দীন আহমেদ
পরবর্তীতে যোগ দেন প্রখ্যাত বামপন্হী নেতা তাজউদ্দীন আহমেদ, মোহম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ প্রমুখ তাদের মূল লক্ষ্য ছিল মুসলিম লীগের অন্যতম নেতা, নামে বাঙালি কার্যত বাঙালির শত্রু খাজা নাজিমউদ্দীনের যাবতীয় প্রতিক্রিয়াশীল রাজনতিক কর্মকান্ড প্রতিরোধ করা ভাষার দাবীতে গণ-আজাদী লীগের মেনিফেস্টোতে বলা হয়-
মাতৃভাষার সাহায্যে শিক্ষাদান করিতে হইবে
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা এই ভাষাকে দেশের যথোপযোগী করিবার জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্হা করিতে হইবে বাংলা হইবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা

তমদ্দুন মজলিস : ভাষার দাবীতে ঐক্যবদ্ধ

১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর জন্মলাভ করে সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিস এটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান, অধ্যাপক ছাত্রদের সম্মিলিত উদ্যোগের ফসল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেম ছিলেন এর প্রধান
১৫ সেপ্টেম্বর তারা একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন- ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা- বাংলা না উর্দু?’ এখানে ভাষা বিষয়ক একটি প্রস্তাব করা হয়-
.বাংলা ভাষাই হবে
. পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন
. পূর্ব পাকিস্তানের আদালতের ভাষা
. পূর্ব পাকিস্তানের অফিসাদির ভাষা
.পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটি- বাংলা উর্দু
.. বাংলাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাবিভাগের প্রথম ভাষা পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা একশ জনই ভাষা শিক্ষা করবেন
. পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু হবে দ্বিতীয় ভাষা বা আন্তঃপ্রাদেশিক ভাষা যারা পাকিস্তানের অন্যান্য অংশে চাকুরি ইত্যাদি কাজে নিযুক্ত হবেন, তারাই শুধু ভাষা শিক্ষা করবেন ইহা পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা হইতে ১০ জন শিক্ষা করলেও চলবে মাধ্যমিক স্কুলের উচ্চতর শ্রেণীতে এই ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে শিক্ষা দেওয়া হবে
. ইংরেজি হবে পাকিস্তানের তৃতীয় ভাষা বা আন্তর্জাতিক ভাষা পাকিস্তানের কর্মচারী হিসেবে যারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে চাকুরি করবেন বা যারা উচ্চতর বিজ্ঞান শিক্ষায় নিয়োজিত হবেন তারাই শুধু ইংরেজি ভাষা শিক্ষা করবেন তাদের সংখ্যা পূর্ব পাকিস্তানে হাজারকরা জনের বেশি কখনো হবে না ঠিক একই নীতি হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলিতে ওখানের (স্হানীয় ভাষার দাবী না উঠলে) উর্দু হবে প্রথম ভাষা, বাংলা দ্বিতীয় ভাষা আর ইংরেজি তৃতীয় ভাষার স্হান অধিকার করবে
.শাসনকাজ বিজ্ঞান শিক্ষার সুবিধার জন্য আপাততঃ ইংরেজি বাংলা উভয় ভাষাতেই পূর্ব পাকিস্তানের শাসনকাজ চলবে ইতোমধ্যে প্রয়োজনানুযায়ী বাংলা ভাষার সংস্কার করতে হবে দেশের শক্তির যাতে অপচয় না হয় এবং যে ভাষায় দেশের জনগণ সহজে অল্প সময়ে লিখতে, শিখতে বলতে পারে, সে ভাষাই হবে রাষ্ট্রভাষা এই অকাট্য যুক্তিই উপরোক্ত প্রস্তাবের প্রধান ভিত্তি না হলে ইংজে সাম্রাজ্যবাদ যেমন জনগণের মত না নিয়ে বা তাদের অসুবিধার দিকে না লক্ষ্য রেখে ইংরেজিকে জোর করে আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল- শুধু কিংবা বাংলাকে সমস্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করলে ঠিক সেই সাম্রাজ্যবাদী যৌক্তিক নীতিরই অনুসরণ করা হবে অথচ এই অবজ্ঞানিক অযৌক্তিক প্রচেষ্টাই আজ কোন কোন মহলে দেখা দিয়েছে ইহা সত্যিই বড় লজ্জাকর দুর্বল মনের অভিব্যক্তি একে সর্বপ্রকারে বাধা দিতে হবে এর বিরুদ্ধে বিরাট আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এরই সূচনা হিসেবে আমরা কয়েকজন লব্ধপ্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকের প্রবন্ধ প্রকাশ করছি এবং সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যেককে এই আন্দোলনে যোগ দেবার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি


Share this :

Previous
Next Post »
ADSENSENSE AD CODE