১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে ঊনসত্তরের জনগণের আন্দোলন যে কেবল ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল তাই- নয় এর মাধ্যমে আইয়ুব খানের শাসনামলে সাধিত উন্নয়ন সমৃদ্ধির যথার্থ রূপটিও পৃথিবীর সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়ে ছাত্র অসন্তোষকে কেন্দ্র করে ১৯৬৮ সালের নভেম্বরে যে প্রাথমিক ঘটনাবলির সূত্রপাত তা পরবর্তীকালের কেবলমাত্র ছাত্র সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ছড়িয়ে পড়ে শ্রমিক-কৃষক ব্যাপক সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি নাগিরক দাবি-আইয়ূবের পতনকে কেন্দ্র করে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের দু অংশের মানুষ সময়ে একযোগে পথে নামে অভ্যুত্থানের পরিণতিতে শুধু আইয়ূব খানের পতন ঘটেনি বরং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয় 

১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ছিল আইয়ুব খানের শাসনামলে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী জঙ্গী আন্দোলন এটি শুরু হয়েছিল সরকারি নির্যাতনবিরোধী একটি সাধারণ লড়াই হিসেবে কিন্তু অচিরেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের রূপ নিয়ে তা ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রামে গঞ্জে আন্দোলনের চরিত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে ব্যাপক গণজাগরণের মধ্য দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনের তাৎপর্যও বৃদ্ধি পেয়েছে গণআন্দোলন সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গেলেই বলতে হয় ১১ দফার কথা 

কর্মসূচির ফলে ছাত্র সমাজ স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে এক প্রতিরোধ দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন ১১ দফা দফার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে দেশব্যাপী এক প্রচ- গণবিপ্লবের সৃষ্টি হয় গণ আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি লক্ষ্য করে ক্ষমতাসীন সরকার দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং তা প্রতিহত করতে পাক সরকার হত্যা নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে ফলে আন্দোলন আরো তীব্র জোরালো হতে থাকে এবং সমগ্র দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে 

আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আইয়ূব খান মুজিবসহ সকল রাজবন্দিদের বিনাশর্তে মুক্তি প্রদান করেন তীব্র আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হন আন্দোলনের সুফল হিসেবে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিনিধি নির্বাচনের স্বীকৃতি মিলে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গ্রাম শহরাঞ্চলে শ্রেণি চেতনার উন্মেষ ঘটে এবং শ্রেণি সংগ্রামের আংশিক বিকাশ সাধিত হয় প্রকৃত পক্ষে আন্দোলনের ফলে সবচেয়ে বড় লাভ হলো স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বাঙালিদের যে জাতীয়তাবোধ ১৯৪৮ এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল তা পূর্ণতা লাভ করে আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বামপন্থীদের বৃহৎ অংশ এবং ডানপন্থী সংগঠনভুক্ত সদস্যদের মধ্যে পূর্ববাংলায় পৃথক রাষ্ট্র গঠনের আকাক্সক্ষা বৃদ্ধি পায় ছাত্রলীগের সভায় স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার প্রস্তাব গৃহীত হয় শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার চেতনা জনপ্রিয়তা লাভ করে যার ফলে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ৃদ্ধি পায়

১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান জাতীয় চেতনার প্রতীক একুশে ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। সময় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণার দাবি জানিয়েছিল।৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ২১ ফেব্রুয়ারিকে ছুটির দিন ঘোষণা করেছিল। কিন্তু৫৮ সালে সামরিক আইন জারির পর তা বাতিল হয়।৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের ফলস্বরূপ ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্বের মর্যাদা ফিরে পায়।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পেছনে৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের প্রভাব ছিল প্রত্যক্ষ এবং সক্রিয়। বাঙালিদের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এবং বাঙালি জাতির স্বাধিকার অর্জনের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সর্বদা অটল এবং প্রতিবাদমুখর।৬৯-এর গণআন্দোলন শেখ মুজিব সহ আওয়ামীলীগ নেতাদের মুক্তির পথ সুগম করেছিল। মুক্তিলাভের পর শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির স্বার্থ রক্ষায় সদা সজাগ সক্রিয় ছিলেন।

এর ফলে তার জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে।৬৯ এর গনঅভ্যুত্থানে সমাজতান্ত্রিক দলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আর৭০-এর নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে শেখ মুজিবুর রহমান সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা আদর্শকে সংযুক্ত করায় বামপন্থীদের সমর্থন লাভ করেন। সর্বোপরি৬৯এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলায় যে জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠে।৭০-এর নিবাচনে তা পুরোপুরি আওয়ামী লীগের পক্ষে চলে যায়

লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, মানবাধিকার কর্মী

Share this :

Previous
Next Post »
ADSENSENSE AD CODE